লালমনিরহাটের ছোট্ট গ্রাম থেকে উঠে আসা উম্মে কুলসুম পপি আর রংপুরের বদরগঞ্জের ধর্মপুর গ্রামের সাগর—দুজনের শৈশবই কেটেছে প্রকৃতি আর কৃষির আলিঙ্গনে। ঘাসফড়িংয়ের লাফ, মাঠের বাতাস, নদীর চরের বিকেল—এগুলোই তাদের বেড়ে ওঠার পরিচিত ছবি। পরবর্তী সময়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ক্যাম্পাসে দেখা হওয়ার পর সেই প্রকৃতিপ্রেম আরও দৃঢ় রূপ নেয়। আর সেই ভালোবাসাই তাদের জীবনকে এনে দেয় এক নতুন পরিচয়—কৃষিভিত্তিক কনটেন্ট নির্মাতা ও উদ্যোক্তা।
কেন আলাদা পপির ভিডিও
আজকাল ভিডিও বানান অনেকেই। তবে পপির কনটেন্ট কেন এত গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি প্রথমে বিষয় ঠিক করি। তারপর খুঁজে দেখি কীভাবে সেটি সহজভাবে বোঝানো যায়।”
ফসলের মাঠ, ফলের বাগান—যে বিষয়টি নিয়ে ভিডিও বানান, তার খুঁটিনাটি নিজে আগে বুঝে নেন। তাই তার ভিডিওতে থাকে নির্ভরযোগ্য তথ্য, সহজ ভাষা এবং দর্শকের প্রয়োজন মাথায় রেখে সাজানো কাঠামো।
ইউটিউব চ্যানেলের প্রতিটি প্লেলিস্টও সাজানো নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর—ফুল, ফল, মাছ, মসলা, ঔষধি গাছ—যা দর্শককে সহজেই পছন্দের বিষয় খুঁজে নিতে সাহায্য করে।

তার প্রথম ভিডিওর স্মৃতিও রয়ে গেছে বিশেষ হয়ে। তিস্তার এক চরে কুমড়া চাষ নিয়ে সেই ভিডিওটি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি প্রশংসা এনে দেয় তাকে—যা তাকে পরবর্তী পথচলার বড় প্রেরণা দেয়।
উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প: ‘বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট’ থেকে ‘প্রিমিয়াম ফ্রুটস’
তাদের উদ্যোক্তা যাত্রার শুরু ২০১৬ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শুরু করা ‘বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট’ মূলত রংপুরে ইলেকট্রনিক ডিভাইস সার্ভিসিং, শিফটিং সার্ভিস, টেকনিশিয়ান হোম সার্ভিস, দুধ ও গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ এমনকি রেন্ট-এ-কার পর্যন্ত—বহুমুখী সেবা দিতে থাকে।
তাদের ধারণাপত্র ব্র্যাকের আরবান ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড–২০১৭ জিতে নেয়। পুরস্কার হিসেবে পাওয়া ৫ লাখ টাকা তাদের উদ্যোগে নতুন গতি আনে। পরে পাওয়া ২০ লাখ টাকার বিনিয়োগ এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অর্জিত স্বীকৃতি তাদেরকে পোক্ত ভিত্তি দেয়। ধীরে ধীরে ৭০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে।
প্রিমিয়াম ফ্রুটস: নিরাপদ ফলের দেশব্যাপী সরবরাহ
করোনার সময়ে ২০২০ সালে তারা শুরু করেন নতুন উদ্যোগ—প্রিমিয়াম ফ্রুটস। প্রথমদিকে উত্তরাঞ্চলের উচ্চমানের আম দেশজুড়ে সরবরাহ করতেন। পরে খাগড়াছড়ির পেঁপে, বান্দরবানের পাহাড়ি কলা, মৌলভীবাজারের জাম্বুরা—দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফল সংগ্রহ শুরু হয়।
ফল উৎপাদন ও সরবরাহকে নিরাপদ করতে তারা সরাসরি কৃষক ও বাগানমালিকদের সঙ্গে কাজ শুরু করেন, অগ্রিম চুক্তির মাধ্যমে বাগানের ইজারা নেন, এবং প্রতিটি পর্যায়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করেন। ফলে ফলের গুণমান বজায় থাকে এবং গ্রাহক পান নির্ভরযোগ্য পণ্য।
আগামীর স্বপ্ন: অ্যাগ্রো ট্যুরিজম থেকে রপ্তানি
পপি ও সাগর এখন নতুন এক স্বপ্নপথে হাঁটছেন—অ্যাগ্রো ট্যুরিজম প্রজেক্ট। যেখানে একইসঙ্গে থাকবে ফলের বাগান, শাকসবজি, পুকুরের মাছ, খামারের দুধ—সবকিছুর সরাসরি অভিজ্ঞতা। দর্শনার্থীরা প্রকৃতি ও কৃষির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়তে পারবেন।
অন্যদিকে, তারা নিরাপদ ফল রপ্তানির পরিকল্পনায়ও এগোচ্ছেন, পাশাপাশি ১০০ জন প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ানের ক্যারিয়ার গড়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছেন ‘বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট’-এ।
তরুণদের প্রতি বার্তা
পপি ও সাগরের বিশ্বাস—বাংলাদেশের কৃষিতে সীমাহীন সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু তরুণদের অংশগ্রহণ এখনও কম। তারা মনে করেন,
“তরুণরা যত বেশি কৃষিতে আসবে, তত বেশি নিরাপদ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।”
কৃষির মাঠ থেকে শুরু করে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম—তাদের পথচলা এখন অনেক তরুণের অনুপ্রেরণার নাম।


