দেশে কৃষিভিত্তিক নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি করতে বড় ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এই লক্ষ্যে উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদন বাড়ানো, ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানো, সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বাজারজাতকরণে সুবিধা বাড়াতে একটি নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পটি দেশের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘উচ্চমূল্যের ফসল বাজারজাতকরণ এবং উৎপাদন বাড়ানো’ শীর্ষক এই প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১০ কোটি ডলার (স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা) ঋণ সহায়তা দেবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের কৃষি এখন আধুনিকায়নের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই রূপান্তরের মূল লক্ষ্য হলো কৃষিকে লাভজনক করা, যাতে শিক্ষিত তরুণরা এখানে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়তে পারেন।
উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে মূলত ফলমূল (যেমন: ড্রাগন ফল, স্ট্রবেরি) এবং শাকসবজি (যেমন: ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, গাজর) বিবেচনা করা হয়। এসব ফসলে সনাতন কৃষিপণ্যের চেয়ে লাভ অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, এক বিঘা জমিতে ড্রাগন ফল চাষ করে একজন কৃষক ২ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন, যা ধান বা প্রচলিত সবজি চাষে সম্ভব নয়।
কৃষিকে এগিয়ে নিতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও বাণিজ্যিক উদ্যোক্তারা প্রায়ই প্রচলিত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় কৃষির অগ্রাধিকার খাতে (আমদানি-বিকল্প ফসল) ঋণের সুদ ৪ শতাংশ হলেও, উচ্চমূল্যের ফসলের নতুন উদ্যোক্তারা এই সুবিধা পান না।
কৃষি মন্ত্রণালয় মনে করছে, প্রচলিত বাণিজ্যিক সুদহার (যা অনেক বেশি) কৃষি উদ্যোক্তা বিকাশে বড় অন্তরায়।
এই প্রকল্প সফল করতে গত ৬ নভেম্বর অর্থ বিভাগের সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদারের কাছে একটি চিঠি লিখেছেন কৃষি সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান।
চিঠিতে বলা হয়, প্রস্তাবিত ১০ কোটি ডলারের মধ্যে ৬ কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষি উদ্যোক্তা পর্যায়ে বিতরণ করা হবে।
এডিবি এই ঋণ বাংলাদেশকে দিচ্ছে সহজ শর্তে (২ শতাংশ সুদে, ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২৫ বছরে পরিশোধযোগ্য)। তাই কৃষি মন্ত্রণালয় চাইছে, উদ্যোক্তা পর্যায়েও যেন এই ঋণের সুদহার কম রাখা হয়।
কৃষি সচিব ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা পর্যায়ে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৪ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে অর্থ সচিবের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ হলেও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এই খাতের অবদান ক্রমেই কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ৩১ শতাংশের বেশি, যা গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১১ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। গত অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সম্ভাবনার তুলনায় দেশের কৃষি খাত পিছিয়ে আছে। এর বড় কারণ বাস্তবধর্মী পরিকল্পনার অভাব, কাঙ্ক্ষিত আধুনিকায়ন না হওয়া এবং নতুন উদ্যোক্তা গড়ে না ওঠা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৯৯ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, নতুন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিলে এই খাতের রপ্তানি আয় বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব।


