সোমবার, ডিসেম্বর ১, ২০২৫

বন্য হাতির তাণ্ডব, দুশ্চিন্তায় কৃষকেরা

শেয়ার করুন

শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তবর্তী ছোট গজনী গ্রামের গৃহিণী লতা সাংমা (২৫)। স্বামী, দুই সন্তান ও মা–বাবাকে নিয়ে তাঁর সংসার। চলতি আমন মৌসুমে পাহাড়ের ঢালে ৫০ শতক জমিতে প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ করে ধানের আবাদ করেছেন। ধান পাকতে ও কাটতে আরও ১০-১২ দিন সময় লাগবে। এ সময়ে ফসলি জমিতে বন্য হাতির আক্রমণের ভয়ে দিন-রাত পাহারা দিচ্ছেন।

লতা সাংমার ভাষ্য, ‘এই ধানেই সংসারের খাওয়ন চলে। ধারদেনা কইরা চাষ করছি, ফসল ভালো অইছে; কিন্তু আত্তির ডরে (হাতির ভয়ে) থাহুন লাগে। ধান ঘরে তুলতে না পারলে পরিবার লইয়া মহাবিপদে পড়ুম।’

লতার মতো শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি ঢালের অন্তত ৩৫ থেকে ৪০টি গ্রামের শত শত কৃষক একই দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।

জেলার বন বিভাগ ও কৃষি কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, তিন উপজেলার সীমান্তঘেঁষা এলাকায় চলতি মৌসুমে ১২ হাজার ২৪৪ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের আবাদ হয়েছে—শ্রীবরদীতে ৪ হাজার ৪০১, ঝিনাইগাতীতে ৩ হাজার ২৩৯ এবং নালিতাবাড়ীতে ৪ হাজার ৬০৪ হেক্টর।

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, গত সোমবার রাতে ৩০-৩২টি বন্য হাতির একটি পাল তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে শ্রীবরদীর বালিঝুড়ি, মালাকুচা ও গলাচিপা জঙ্গলে অবস্থান নেয়। নালিতাবাড়ীর সমশ্চুড়া এলাকায় আছে আরও ৩০-৩৫টি হাতি, আর পানিহাটা-ফেকামারী জঙ্গলে রয়েছে ৪০-৪২টি হাতির আরেকটি পাল। সন্ধ্যা নামলেই খাদ্যের সন্ধানে হাতিগুলো লোকালয়ে নেমে আসে।

বন বিভাগের তথ্যে জানা যায়, প্রায় দুই মাস ধরে সীমান্ত এলাকায় তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে শতাধিক হাতি অবস্থান করছে। সঙ্গে রয়েছে ১৫ থেকে ২০টি বাচ্চাও। এ সময়ে শ্রীবরদীর বালিঝুড়ি, কনঝুড়া, মালাকুচা ও গলাচিপা গ্রামের ৪০ জন কৃষকের ৭-৮ একর, ঝিনাইগাতীর গোমড়া গ্রামের ১২ কৃষকের ৩-৪ একর এবং নালিতাবাড়ীর পশ্চিম সমশ্চুড়ার ৩০ জন কৃষকের ১৬ একর ধানখেত খেয়ে ও পায়ে মাড়িয়ে নষ্ট করেছে হাতির পাল। ধান পাকতে শুরু করায় আতঙ্ক আরও বেড়েছে। অনেকে ভয়ে আধপাকা ধান কেটে ফেলেছেন।

শ্রীবরদীর গলাচিপা গ্রামের কৃষক আলভারেস মারাক বলেন, ‘পাহাড়ের ঢালে ধারদেনা কইরা আমরা আমন লাগাইছি। ফসল ভালো হইছে; কিন্তু জঙ্গলে দুই সপ্তাহ ধরে আত্তি আছে। হের লাইগা ধান লইয়া আমরা দুশ্চিন্তায় আছি।’

ধান পাকার সময় হাতি খাদ্যের জন্য লোকালয়ে ঢোকে বলে জানান ঝিনাইগাতী এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের সভাপতি আব্রাহাম এম সাংমা। তাঁর ভাষায়, ‘অনেক কৃষকের ধান এখনো কাটাই বাকি। হাতি আসতে দেরি লাগে না, তাই পাহাড়িদের দুশ্চিন্তা লইয়া থাকতে হয়।’

ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আবেদন করতে বলা হয়েছে জানিয়ে নালিতাবাড়ীর সমশ্চুড়া বিট কর্মকর্তা কাওসার হোসেন বলেন, হাতির পালকে যেন কেউ উত্ত্যক্ত না করে, এ ব্যাপারে বন বিভাগ ও এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম সতর্ক আছে।

গোপালপুর বিট কর্মকর্তা আবদুল বারী জানান, ধানখেতে হাতি ঢুকলে মশাল জ্বালিয়ে ও চিৎকার করে সেগুলোকে জঙ্গলে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। শ্রীবরদীর বালিঝুড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমন জানান, ফসল রক্ষায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মশাল জ্বালাতে কেরোসিন সরবরাহ করা হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করতে বলা হয়েছে।

জানতে চাইলে শেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় ধান পাকতে শুরু করেছে। অনেক জায়গায় কাটাও চলছে। আবার হাতির ভয় থাকায় আধপাকা ধান অনেকেই কেটে নিয়েছেন। আশা করছি, ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যেই ধান কাটা শেষ হবে।

সাম্প্রতিক খবর

এই বিভাগের আরও খবর