খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা পৌরসভার দক্ষিণ মুসলিম পাড়ার বাসিন্দা আকবর খাঁ এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তিনি কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, বরং নিতান্তই শখের বশে বাড়ির উঠানের এক কোণে শুরু করেছিলেন গোলমরিচের চাষ। আর সেই শখের চাষেই এখন তিনি অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন।
আকবর খাঁ পেশাগত কাজের পাশাপাশি নতুন কিছু করার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। ২০১৫ সালের দিকে তিনি কৌতুহলবশত ২০টি গোলমরিচের চারা সংগ্রহ করেন। বাড়িতে থাকা আম ও কাঁঠাল গাছের গোড়ায় চারাগুলো রোপণ করেন তিনি। এখন সব গাছই পরিপূর্ণভাবে ফল দিচ্ছে। জাতের নাম ঠিক মনে না থাকলেও গোলমরিচের ঘ্রাণ, স্বাদ ও ঝাঁজ দেখে বোঝা যায় এটি উন্নতমানের প্রজাতি। তাছাড়া গোলমরিচ গাছ যেহেতু পরাশ্রয়ী, তাই আম গাছটিকে অবলম্বন করেই লতিয়ে উঠতে থাকে তার গোলমরিচের গাছ।
প্রথমদিকে কেবল শখের বশেই যত্ন নিতেন আকবর খাঁ। গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি দেওয়া আর সামান্য জৈব সার প্রয়োগেই তিনি সীমাবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু মাটিরাঙ্গার উর্বর মাটি ও পাহাড়ি আবহাওয়া গোলমরিচ চাষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। গাছগুলো দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং আম গাছটিকে প্রায় পুরোটাই ছেয়ে ফেলে।
কয়ক বছর ধরে গাছগুলোতে ফলন আসে। থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা সবুজ গোলমরিচ দেখে আকবর খাঁ নিজেই অবাক হয়ে যান। পরিপক্ক হওয়ার পর কিছু মরিচ লাল বর্ণ ধারণ করেছে, আর কিছু শুকিয়ে কালো বর্ণ ধারণ করেছে, যা দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি এর বাণিজ্যিক মূল্যও অনেক।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আকবর খাঁ-এর এই শৌখিন উদ্যোগটি যদি স্থানীয় কৃষি বিভাগের সহায়তায় বাণিজ্যিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে এটি মাটিরাঙ্গার কৃষিতে নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। শখের এই গোলমরিচ চাষই হয়তো একদিন এলাকার অনেক পরিবারের বাড়তি আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে উঠবে।
সফল এই শৌখিন চাষি আকবর খাঁ বলেন, আমি কখনোই ভাবিনি যে শখের বশে লাগানো গাছ থেকে এত ভালো ফলন পাবো। ফলন বিবেচনায় প্রতি সিজনে ৮-১০ কেজি গোলমরিচ হারভেস্ট করা যায়। স্থানীয় বাজারে কেজি প্রতি ১২শ টাকা করে বিক্রি করেছি। গোলমরিচ যে আমাদের মাটিরাঙ্গার মাটিতে এত ভালো হবে, তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। এই গোলমরিচ সম্পূর্ণ বিষমুক্ত ও অর্গানিক। নিজের পরিবারের চাহিদা মিটিয়েও আমি এগুলো বিক্রি করতে পারব।
তিনি আরও বলেন, গোলমরিচ একটি অত্যন্ত দামী মসলা। আমার মনে হয়, বাড়ির উঠানের খালি জায়গায় বা বড় গাছের পাশে যে কেউ খুব সহজে এর চাষ করতে পারে। এতে তেমন কোনো বাড়তি খরচ বা জায়গার প্রয়োজন হয় না।
আকবর খাঁর এই সাফল্য দেখে এলাকার অনেকেই এখন গোলমরিচ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তার বাড়িতে লাগানো গোলমরিচের লতা এবং তাতে ঝুলে থাকা ফলন দেখতে অনেকেই ভিড় করছেন। কেউ কেউ তার কাছ থেকে চারা সংগ্রহ ও চাষাবাদের পদ্ধতি সম্পর্কে পরামর্শ নিচ্ছেন।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা উদ্যানতত্ত্ববিদ মাকসুদুর রহমান বলেন, কৃষি উদ্যানের আওতায় জেলায় চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) বিভিন্ন চাষির মাঝে দেশীয় বারি-১ জাতের গোল মরিচের ৬০টি প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি প্রদর্শনীতে ২০টি করে গাছের চারা রয়েছে।
তিনি জানান, গাছের বয়স ৩ থেকে ৪ বছর হলে ফল ধরা শুরু হয় এবং ৮ বছর বয়সে সর্বোচ্চ ফলন দেয়। সুস্থ গাছে বছরে একবার ফলন হয় এবং প্রতিটি গাছ থেকে ৩ থেকে ৪ কেজি পর্যন্ত গোল মরিচ পাওয়া যায়। সরকারিভাবে এই ফসলে কোনো প্রণোদনা বা বীজ সহায়তা প্রদান করা হয় না। তবে পাহাড়ি এলাকায় ‘অপকা’ নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গোল মরিচ চাষ নিয়ে কাজ করছে।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. সবুজ আলী বলেন, খবর পেয়ে কৃষক আকবর খাঁর গোলমরিচ গাছ পরিদর্শন করেছি। আকবর খাঁর এই সাফল্য সত্যিই প্রশংসনীয়। এটি প্রমাণ করে যে, আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া গোলমরিচের মতো মূল্যবান মসলা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
তিনি আরো বলেন, গোলমরিচ চাষের জন্য যে ধরনের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া এবং সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ মাটির প্রয়োজন, তার সবই মাটিরাঙ্গায় বিদ্যমান। আমরা অন্যান্য কৃষকদেরও বাড়ির আঙিনায় বা বাগানের বড় গাছের ফাঁকে ফাঁকে গোলমরিচ চাষে উৎসাহিত করছি। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী ও লাভজনক ফসল। আকবর খাঁর মতো আগ্রহী চাষিদের যে কোনো কারিগরি পরামর্শ ও সহযোগিতা দিতে উপজেলা কৃষি অফিস প্রস্তুত রয়েছে।


