বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১৩, ২০২৫

জাল টাকার ছায়ায় অর্থনীতি ও নির্বাচন বিপর্যয়ের মুখে

Share

সীমান্তে কঠোর নজরদারি ও তল্লাশির মধ্যেও ঢুকে পড়ছে জাল টাকা। এতটাই নিখুঁতভাবে তৈরি এসব নোট যে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যাংক কর্মকর্তারাও বিভ্রান্ত হচ্ছেন। অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও নির্বাচনী নিরাপত্তার জন্য বিষয়টি এখন শুধু আর্থিক নয়, রাজনৈতিক হুমকি হিসেবেও দেখা দিচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চক্রের মূল হোতা হাসান ও তার সহযোগী রাসেল ভারতের ভেতরে জাল নোট তৈরি করে তা বাংলাদেশে পাচার করে। এক লাখ টাকার জাল বান্ডেল পেতে ক্রেতাকে দিতে হয় প্রায় ৩৬ হাজার টাকা। প্রতিটি বান্ডেল এতটাই নিখুঁত যে বিশেষজ্ঞদের কাছেও আসল-নকল পার্থক্য করা কঠিন। নোটগুলোতে রঙ পরিবর্তনশীল নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকলেও ইউভি ফিচার নেই— যা শুধুমাত্র মেশিনে শনাক্ত করা সম্ভব।

শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার হতদরিদ্র নারী শাহিনা বেগম নিজের জীবনের সঞ্চয় হারিয়েছেন এই জাল টাকার ফাঁদে পড়ে। তিনি পোস্ট অফিস থেকে পাঁচ বছর ধরে জমানো টাকা ব্যাংকে জমা দিতে গিয়ে জানতে পারেন— পুরো টাকাই জাল। একই দিন ওই পোস্ট অফিস থেকেই আরেকজন গ্রাহক ২৫ হাজার টাকার জাল নোট পান। ঘটনাটি প্রকাশ পেলে সিসিটিভি ফুটেজ ও ব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতে ক্যাশিয়ার মানিক মিয়া ও ট্রেজারার হাফিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

জিজ্ঞাসাবাদে হাফিজুর জানান, নোটগুলো পোস্ট অফিস থেকেই সরবরাহ করা হয়েছিল। এরপর বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থা তাঁদের কললিস্ট বিশ্লেষণ করে জানতে পারে, তাঁরা সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী এলাকার একটি চক্রের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। স্থানীয় সূত্র বলছে, মাদক, প্রসাধনী ও অন্যান্য চোরাচালানের সঙ্গে জাল টাকার চালানও সীমান্ত পেরিয়ে আসছে।

বিজিবির তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়ন (৩৯ বিজিবি) ২৫ জনকে গ্রেপ্তারসহ ২৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকার চোরাচালান পণ্য, গবাদিপশু, মাদক ও জাল টাকা জব্দ করেছে।

সাম্প্রতিক এক অভিযানে গোপালগঞ্জ সদর থানার পুলিশ হাবিবুর ও রিপন শেখ নামের দুই জাল টাকার ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় দুই লাখ ৪৩ হাজার টাকার জাল নোট, নগদ তিন লাখ ৮৩ হাজার আসল টাকা ও একটি প্রাইভেট কার। তাঁদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ জানায়, হাবিবুরের বিরুদ্ধে ব্যাংক ডাকাতিসহ দুটি এবং রিপনের বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন,

“জাল টাকা অনুপ্রবেশের বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। টাকার সঠিক প্রচলন ব্যাহত হলে অর্থনীতিতে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে— কারণ যার কাছেই জাল নোট পাওয়া যাবে, সে-ই দায়ী থাকবে।”

বিজিবির ময়মনসিংহ সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান জানান,

“সীমান্ত দিয়ে জাল টাকা পাচারের যেকোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে আমরা সর্বোচ্চ তৎপর আছি। বিশেষ করে শেরপুরের পাহাড়ি এলাকায় টহল, অভিযান ও গোয়েন্দা নজরদারি আরও জোরদার করা হয়েছে।”

একইভাবে জয়পুরহাট ২০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল লতিফুল বারী জানান,

“জাল টাকার তথ্য পাওয়ার পর থেকেই অতিরিক্ত টহল, গোয়েন্দা নজরদারি এবং সীমান্ত পোস্টগুলোতে কড়া সতর্কতা জারি করা হয়েছে।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় কিছু মহল ভোটার বিভ্রান্তি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নতুন করে জাল নোট ছড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। ফলে জাল টাকা এখন শুধু আর্থিক নয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার হুমকিতেও পরিণত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সুপারনিউমারি অধ্যাপক ও বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন,

“জাল টাকা প্রবেশ মানেই অর্থনীতির ক্ষতি। তবে সরকার ও ব্যাংকগুলো এখন অনেক সচেতন। ডিজিটাল লেনদেন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ন্ত্রণে থাকবে।”

Read more

Local News