সোমবার, ডিসেম্বর ১, ২০২৫

সন্দ্বীপের ডুবোচরে আমনের সোনালি স্বপ্ন পূরণ

শেয়ার করুন

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম উপকূলজুড়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার লম্বা ও ৩ কিলোমিটার চওড়া নতুন যে চরটি জেগে উঠেছে, স্থানীয়রা একে ‘ডুবোচর’, ‘ডোবাচর’ বা ‘ডুবাগা’ নামে চেনেন। ‘ডুবাগা’ শব্দের অর্থ—যে চর জোয়ারে ডুবে যায়। কয়েক বছর আগেও চরটি মূলত মাছ চাষের জন্য ব্যবহৃত হতো। এবার প্রথমবারের মতো বড় পরিসরে ধান আবাদ করে কৃষকেরা পেয়েছেন আশাতীত ফলন। ধানের পাশাপাশি মাছ চাষেও সমান আয় হচ্ছে তাঁদের।

গতকাল রোববার ডুবোচরে গিয়ে দেখা যায়, পাকা সোনালি ধানে নুয়ে পড়েছে গোটা মাঠ। কৃষকেরা কেউ ধান কাটছেন, কেউ জমি থেকে ধান এনে স্তূপ করছেন, আবার কেউ ট্রাক্টরে করে ঘরে তুলছেন ফসল। তাঁদের ভাষ্য, চরের প্রায় ৫০০ কানি জমিতে এবার ধান হয়েছে অন্তত ৩০ হাজার মণ বা প্রায় ১ হাজার ২০০ টন—যা তাঁরা ‘বাম্পার ফলন’ বলেই উল্লেখ করছেন।

কৃষকেরা জানান, গত মৌসুমে পরীক্ষামূলক চাষে ভালো ফল মেলায় এবার ধানচাষ বেড়েছে ১০ গুণ। আগামী বছরগুলোতে এই পরিমাণ আরও বাড়বে বলে তাঁদের আশা। তবে ফলন ভালো হলেও কোনো মাঠ কর্মকর্তাকে সেখানে পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। সন্দ্বীপের কৃষি কর্মকর্তা মো. মারুফ হোসেন বলেন, তিনি যদিও ডুবোচরে যাননি, তবুও সেখানকার আমনের ভালো ফলনের খবর তাঁর জানা আছে।

চাষ বাড়ছে দ্রুত

জোয়ারের নোনাজলে টিকে থাকা শতবর্ষী জাত ‘রাজাশাইল’ ধান গতবার পরীক্ষা করে দারুণ ফল পাওয়া যায়। সে অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে এবার ৫০০ কানি জমি আবাদ করা হয়েছে। চরের কেন্দ্রস্থলে ধান কাটছিলেন ৫৫ বছর বয়সী নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আগামী মৌসুমে এখানে চাষ এক হাজার কানি ছাড়িয়ে যাবে।

আরেক কৃষক নুর উদ্দিন (৫০) জানান, এ বছর তিনি ১২ কানি জমিতে ধান লাগিয়ে ভালো লাভের আশা করছেন। ভবিষ্যতে এই পরিমাণ বাড়িয়ে ২০ কানিতে নেওয়ার পরিকল্পনা তাঁর। নুরুল ইসলাম ও নুর উদ্দিনের মতোই বহু কৃষক স্বপ্ন দেখছেন বিস্তৃত জমিতে আরও বেশি আবাদ করার।

ধানের পাশাপাশি মাছ—দুই আয়ের উৎস

ডুবোচরে শুধু ধান নয়, ধানের জমিতে মাছ চাষও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কৃষকেরা বলছেন, দুই ফসলেই মিলছে সমান সাফল্য। তালিম হোসেন নামে এক যুবক পূর্বপুরুষের জমিতে ফিরে ১২ কানি জমিতে ধান আবাদ করেন। একই জমিতে মাছ চাষ করে এবার তিনি বিক্রি করেছেন প্রায় ২২ লাখ টাকার মাছ। সামনে এই আয় আরও বাড়বে বলে ধারণা তাঁর।

সন্দ্বীপের সবুজচর ও ডুবোচরের ধানক্ষেত থেকে আহরিত মাছের হাট নিয়ে প্রথম আলো ১১ অক্টোবর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। কৃষকেরা বলছেন, এখন তাঁদের মূল আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে এই দুই ফসল।

ফলনে পলির জাদু

কৃষকেরা জানান, প্রতি বছর জোয়ারের জলে ডুবোচরে নতুন পলি জমে, যা জমিকে করে তোলে উর্বর। পাশের সবুজচর বা স্বর্ণদ্বীপে এখন আর নতুন পলি জমে না। ফলে ডুবোচরে অদূর ভবিষ্যতেও ফলন বেশি থাকবে বলে তাঁদের ধারণা। তালিম হোসেন বলেন, “যত দিন পলি জমবে, তত দিন আমন ও মাছ—দুটোই বাম্পার হবে। পরে চর আরও উঁচু হলে ফলন কমে যাবে।”

পরিবহন ও শ্রমিক সংকটে ভোগান্তি

বাম্পার ফলন হলেও কৃষকেরা বড় ধরনের শ্রমিক সংকটে পড়েছেন। একই সময়ে পাশের সবুজচরেও প্রায় চার হাজার কানি জমিতে ধান কাটার মৌসুম—ফলে শ্রমিক চাহিদা বেশি হলেও সরবরাহ কম। যাতায়াতে দুরবস্থা আরও বাড়িয়েছে। জনবসতি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের এই চরে কোনো রাস্তা নেই। জমিতে ব্যবহৃত ট্রাক্টরই একমাত্র ভরসা। কৃষক মোস্তফা (৬২) বলেন, “ট্রাক্টর না থাকলে ধান ঘরে তোলা যেত না। বৃষ্টি বা লঘুচাপে ধান নষ্ট হওয়ার ভয় সবসময় থাকে।”

প্রবাস থেকে ফিরে বসতি গড়ছেন সাবেক বাসিন্দারা

ডুবোচরে আশাতীত ফলন স্থানীয়দের পাশাপাশি সাবেক বাসিন্দাদেরও টানছে। ষাটের দশকে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হওয়া সন্দ্বীপের বাটাজোড়া, কাটগড় ও হুদ্রাখালী ইউনিয়নের বহু পরিবার দীর্ঘদিন বাইরে ছিলেন। নতুন চর জাগার পর তাঁরা আবার ফিরে এসে চাষ শুরু করেছেন। কেউ কেউ ইতোমধ্যে বসতঘর তুলছেন, পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাসও শুরু করেছেন। চরের ধানক্ষেত দিয়ে হাঁটলে বাতাসে দুলতে থাকা ধানের শব্দ যেন নতুন জীবনের বার্তা বহন করে।

সাম্প্রতিক খবর

এই বিভাগের আরও খবর